পার্থসারথী লাহিড়ী
বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছি, বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছি।
পার্থসারথী লাহিড়ী
রোববার বলে কোন বিশেষ দিন এখন আমার নেই তবু্ও ওই যে চিরকেলে বলে একটা কথা আছে না? আমি সাধারণত শনিবার রাতেই সবটা সেরে রেখে দেই যাতে পরের দিন রোববার সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠে পরতে না হয়। গতকাল সন্ধ্যা থেকেই রাতটা অন্যরকম হয়ে উঠেছিল। আমার সাংসারিক কর্তব্যটা সেরে ওঠা হয় নি। সুতরাং আজ রোববার আমার মোটেও ভাল্লাগে না কিন্তু অগত্যা একমাত্র আমাকেই সেই বাকি পরে থাকা সাপ্তাহিক কর্তব্যটা সেরে ফেলতে হবে। সক্কাল সক্কাল ঘুম ছেড়ে ওঠা বড় বিড়ম্বনা, যথারীতি রবীবাবু প্রায় মাথার চাঁদির নব্বই ডিগ্রী লম্ব বরাবর। যখন বাজারের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম তখন সূর্যদেব চাঁদি ফাটাচ্ছে। রাস্তার ডানদিকে শিরিশ গাছের ছায়ায় বাইক স্ট্যান্ডের দিকে ঘুরতে যেতেই আর এক মোটরবাইকের মুখোমুখি।
- ইন্ডিকেটরটা দিন।
দেখলাম ইন্ডিকেটর দেওয়া হয় নি। অপরাধী ঘুম ঘুম চোখে অপরাধ স্বীকার করে নিলাম।
- এভাবে হয় না বুঝলেন!
হতাশ ভদ্রলোকটি বোধহয় আরও কিছু বলতে চাইছিলেন কিন্তু আমার শ্বেত শ্মশ্রুগুম্ফ দেখে কথা বাড়ালেন না। অবজ্ঞায় পাশ কাটিয়ে চলে গেলেন। এরম পাশ কাটিয়ে গেলে কোথায় যেন লাগে। একটা অন্তত গালি দিয়ে যেতে পারত! অথচ কিছুটি আর না বলে যেতে যেতে শুধু যা কিছু ছুড়ে দিয়ে গেলেন তাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল। এরম ঘুম ভেঙে গেলে কষ্ট হয়। জেগে ওঠার ভেতর থেকে কোথায় যেন তিব্র খোঁচা লাগে, সূক্ষ্ম তার ছুরির ফলা, একটা শুষ্ক গোঙানির আওয়াজ কেউ টের পায় না অথচ চিকন দংশনে ফালা ফালা করে দিচ্ছে।...
শিরিশ গাছের ছায়ায় মোটরসাইকেলটা রেখে বাজারে ঢুকলাম। বাজার করতে করতে সেই ব্যথা ভুলে গেছি। জীবনের প্রতিদিনের প্রতিটা মুহূর্ত ঘটনা বহুল। সবগুলোকে মনে রাখা যায় না। ভুলতে হয় অথবা সময় ভুলিয়ে দেয়। অনেকটা কাটা চেড়া ঘায়ের মত, সময়ে মিলিয়ে যায় তার দাগ। বাজারে ঢুকতে ঢুকতে এদিক ওদিক থেকে আওয়াজ ভেসে আসছে, বাজার আজ ভাল নয়। ভাবলাম মাসের প্রথম দিক বাজার ভাল নয় মানে? শুনলাম দফায় দফায় মিটিং হচ্ছে... কিসের মিটিং? হঠাৎ দেখলাম দোকান পাট ছেড়ে বাজারের লোকজন বাজারের পেছন দিকে হরি মন্দিরের দিকে ছুটছে। আমার দোকানদারের কাছে জানতে চাইলাম ব্যাপারটা কী?
- নতুন ভিখারি এসেছে বাজারে। আগে একে কোনদিন আমরা দেখি নি।
- মানে?
- আমরা এই বাজারে ভিক্ষা করতে আসা সব্বাইকে চিনি, তারা আমাদের
সব্বাইকে। তাদেরকে আমরা ভিখারি ভিখারিনী ভাবি না। তারা আমাদের
সহ নাগরিক।
- তাহলে?
- কথায় কথায় আমরা জেনেছি ওরা সদ্য বাংলাদেশ থেকে এসেছে।
- কেন?
- জানেন না বাংলাদেশ আবার নতুন করে স্বাধীন হয়েছে? ...
একটা আশ্চর্য, একটা অদ্ভুত তির্যক প্রশ্ন ভরা তার দৃষ্টি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কী আমাকে খুঁজছে?
- তাহলে কি হবে এখন?
- আমরা সেটাই ভাবছি। নিশ্চই ওদেশে ওরা অত্যাচারিত; না হলে কি
এখানে আসে?
- কিন্তু ব্যাপারটা তো প্রশাসনিক।
- জানি দাদা। কিন্তু ওই তিন জনের পরিবারটার দ্বায়িত্ব কী আমরা
বাজারের দোকানদাররা নিতে পারি না? এই নিয়েই আমাদের
দোকানদারদের মধ্যে দ্বিমত তৈরি হয়েছে। বলছে এরম কত পরিবারের
দ্বায়িত্ব নিবি? একদল আপনার মত বলছে প্রশাসনিক আর আমরা
বেশীরভাগ বলছি ওরা বাংলায় কথা বলে। বাংলা বাংলার পাশে দাঁড়াবে না?
আমার দোকানদারের গলা আড়ষ্ট হয়ে আসে। চোখ লাল করে জল আটকায়। ধরা গলায় বলে – আমার সব মনে আছে দাদা, ১৯৭১, আমার বাবা ... এইটুকু বলে থেমে যায় দোকানদার আরটুকু বলতে পারেন না, হিচকি ওঠে। ঢক ঢক করে জল খান ... কিছুক্ষণ গুম হয়ে থেকে নিজেকে সামলে নেন তারপর দুহাত ছড়িয়ে গান ধরেন - "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি"... স্মৃতি সতত সুখের, স্মৃতি সতত দুখের ... এরম একজন রোম্যান্টিক দোকানদার !! আমার ভাবতে অবাক লাগছে, এতটা দরদ, এত্তখানি আবেগ একজন আলু পেয়াজ রসুনের দোকানদার ! মনে মনে কেমন একটা ভালবাসা জন্ম নিচ্ছে ... কিন্তু, কিছুত্তেই আর একটা কিন্তুকে ছেড়ে যেতে পারছি না ...
- ওদের যদি ফিরে চলে যেতে হয় খুব দুঃখ পাব দাদা। ওই বৈষ্ণব বৈষ্ণবীর
দল, ফকির বাবা যারা প্রতি রবিবার 'করে ভিক্ষা করে, তারাও ওদের
আপন করে নিতে চাইছে; বলছে, আমাদের তো কোন ঘর দুয়ার নাই, চার
দেওয়াল নাই, মাথার উপর নীল চাঁদোয়া। ওরা আমাদের নাই ঘরের উঠানে
না হয় থাকবে, দোতারা আর ডুগডুগিতে ......... কিন্তু সে হবে না দাদা –
- কী হবে না?
- ওরা সেরকমটা হতে দেবে না। ওরা ওদের ওপাড়ে ফিরিয়ে দিয়ে আসবে।
বুঝলাম, যখনই হোক আমার সকালটা আজকের ভাল না। রোববারের স্টেশন ফিডার রোড, বাজারের রাস্তায় ভিড়। বাইক চালিয়ে বাড়ি ফিরতে হবে কিন্তু কিছুতেই কোথাও মননিবেশ করতে পারছি না। একদিকে আজ আটই সেপ্টেম্বর, একমাস হয়ে গেল আর.জি করে, নিজের কর্মস্থলে তিলোত্তমার উপর যৌন অত্যাচার, হত্যা ও তার প্রমাণ লোপাটের প্রচেষ্টা ... আজ অবধি তার কোন সুরাহা হল না, আজ সব্বাই আবার রাত জাগবে প্রতীবাদে। বিচার পায় নি তিলোত্তমা। সমাজের মাথার মধ্যে একরাশ পাপ ঘুরে বেড়াচ্ছে যত্রতত্র, বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে, বিভ্রান্ত করে দিচ্ছে। তার মধ্যে আমার বাইকের ইনডিকেটর, বাজারে বাংলাদেশী পরিবার, বাংলা বনাম বাংলা ...
আমি আনেকটা পথ বাইক হাটিয়ে হাটিয়ে নিয়ে এলাম ভাবলাম, ঠাটা পোড়া এই যে রোদ্দুরে দুপুর, এখন মদ খাওয়া উচিৎ নয়। মদ হল কিছু করতে না পারার একটা ছুতা।

Post a Comment