নীলম শর্মা অংশু
তুমি কোথায় পিয়ালী ঘোষ ?
নীলম শর্মা অংশু
1)
যখনই আমার কোনও বন্ধু
কোলকাতায় গিয়ে পোঁছায়
কোন ন কোনো অজুহাতে
অবশ্যই জিজ্ঞেস করে তোমার ঠিকানা।
আমি এটাই বলি – পিয়ালী ঘোষের সাথে
ন্যাশনাল লাইব্রেরীর সিঁড়ী তে
শেষ দেখা হয়ে ছিল ২০১৩ তে।
তোমার খোঁজে আমার বন্ধুরা
কয়েক বার ন্যাশনাল লাইব্রেরীও গিয়েছেন।
কিন্তূ বড়-বড় চোখ ও রজতশুভ্র কেশবতী
পিয়ালী ঘোষের দেখা মেলে নি।
তাঁরা সীপীএমের আলীমুদ্দীন স্ট্রীটের দপ্ততরে গিয়েও
তোমার কোনও খোঁজ পায়নি।
এক বন্ধু যে ইদানিং কোলকাতায় আছে
আজ সকালে ফোনে বলছিল –
তুমি কেন দাও না তোমার বান্ধবীর ঠিকানা ?
তোমার কবিতা পড়ে আমি
বাংলার সীপীএম ইলেক্শান প্রত্যাশিদের
পুরো লিস্ট ঘেঁটে ফেলেছি
সে যদি ভারতে থাকত তা হলে
দলের সক্রিয় ওয়ার্কর হয়ে থাকত
কোন না কোন ইলেক্শান মিছিলে দেখা হতে পারত।
আমি বললাম – কিউবা, উত্তর কোরিয়া, বিয়তনাম
লাওস বা চিনে চলে গেছে হয়তো
তার প্রয়াত স্বামীর বাকী কাজ-কর্ম গুলো কে সেরে ফেলতে
কোনও নকশাল বহুল এলাকায় চলে গেছে হয়তো।
এও হতে পারে যে তার স্বামীরই মতই হয় তো
কোন মোকাবিলায় মারা গেছে।
তুমি কেমন প্রেমিক ? বন্ধু ক্ষেপে যায়।
আমার স্মৃতি তে একটি শ্বেত-শ্যাম ফিল্ম ভেসে ওঠে।
নিজেকে জিজ্ঞেস করি-
আমি কি কখনও পিয়ালী ঘোষ কে
ভালবেসে ছিলাম ?
১৯৮৪ সালে তার সংগে
যখন প্রথম আলাপ হল
সে ছিল একজন সুদর্শন কন্যা,
যে প্রেসি়ডেন্সি কলেজে
পলিটিকল সাঁইন্স ও সংগীত শিক্ষা
অর্জন করতে-করতে হয়ে উঠেছিল
সীপীএমের একটি গুরুত্বপুর্ন ওয়ার্কর
সে ছিল জ্যোতি বাবুর প্রবল সমর্থক
সর্বহারার অধিকারের আঁদোলনে সক্রিয়।
আমি কী ছিলাম ?
একটি ও্হাইট কলার চাকুরে
একটি সুরক্ষিত প্রেমে আবদ্ধ সামন্য মানুষ।
তাকে ভালোবাসবার আমার
কোনও নৈতিক অধিকার ছিল?
ও একজন ভাল বান্ধবী।
যার সব কিছুই আমাকে চমৎকৃত করত।
আমি কালান্তরে পিয়ালী ঘোশ কে ওভাবেই ভুলে যাই
যেমন একটি শিশু ভুলে যায়ে মায়ের দুধের স্বাদ
কিন্তূ কখন্যই ভোলে না মায়ের সহচার্য়।
সেই দৃষ্টি যে তাকে সিখিয়ে ছিল সম্পর্ক কে বোঝা
পিয়ালী ঘোষে কে দেখেছিলাম একটি সম্পুর্না স্ত্রী রূপে।
শুনেছিলাম পৃথ্বী না কি গোল
আর সময় কখনও ফিরে আসে না।
কিন্তু আমার সামনে এক বলিষ্ঠ গ্রহের মত
২৯ বছর বাদে সময় ফিরে এসেছিল।
পিয়ালী ঘোশ, একটি জলপরিব মত
আমার সামনে দাড়িয়ে
ন্যাশনাল লাইব্রেরীর সিঁড়ি তে।
বয়সের পরিপক্কতা ছাড়া কোনো
পরিবর্তন ঘটে নি তার।
আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়ে গিয়েছিল সে,
তাঁর অভিজ্ঞতা ও জীবন-দৃষ্টি
তাঁর মুখশ্রী কে করে তুলেছে আরও উজ্জ্ঞল।
সে হয়ে উঠেছিল মহাভারতের যুদ্ধের পরের
দ্রৌপদির মত চেতন্য স্ত্রী,
যে সংঘর্ষ, খূন ও হত্যা কে
পরাজয় ছাড়া শালীনতাসহ স্বীকার করে ছিল।
পিয়ালী ঘোশের অদ্ভুত পরিবর্তনের সামনে ছিল
আমার ভৌতিক সুখ-সম্পদার সামন্য আলো,
যা প্রতিক্ষনের পরাজয়ের উপলব্ধি।
তার সাহস ও সংঘর্ষের আলো ছিল সুর্য়ের মত
যা আমার চোখ ধাঁধিয়েছে
আমি তার কোনও আমংত্রন কে
কি ভাবে স্বীকার করি।
সুনেত্রা,
তুমি এই ক্লান্ত আর পরাজিত মানুষের
কঠিন অহংকার কে ভাল করেই চেনো.
বলো আমি পিয়ালী ঘোশের ঠিকানা টি কে
আমার কোন পকেটে যত্নসহকারে রাখতাম?
2)
১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরের শেষ দিন,
খুব মনোরম আবহাওয়া এবং তারায় ভরা রাত ছিল।
ঘরের দরজায় টোকা দিলে
ছয় বছরের একটি কন্যা দরজা খুলে দেয়।
কন্যাটি ছিল আমার মা।
'হাসান চাচা এসেছেন'- মা দাদুভাই কে ডাকলেন।
সেদিন হাসান চাচা মায়ের মাথায় হাত বোলায়নি,
কোনো কৌতুকও বলেনি,
দিদিমার কাছে মিষ্টিও চায়নি,
মুখ ভার করে বসে রইল।
দাদুভাই ঠাকুর ঘর থেকে বেরিয়ে
হাসানের কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন-
' কি মন খারাপ, হাসান ভাই?'
'না... আজ আমি তোমাকে নিয়ে চিন্তিত।
দাদুভাইয়ের চোখেও দুশ্চিন্তা দেখা দেয়।
তিনি একটা গভীর শ্বাস নিলেন।
হাসান চাচা লণ্ঠনের কম্পিত শিখা কে
বইয়ের পাতার মতো পড়ে বললেন,
পণ্ডিত! মুদাস্সার চৌধুরী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন,
আমাদের পাকিস্তানে একটিও কাফের অবশিষ্ট থাকবে না,
এখন তাদের সম্পত্তিও বিক্রি করা যাবে না।
তোমার বাড়ি চৌধুরীর জামাইর পছন্দ হয়েছে।
পণ্ডিত! আজ আমি তোমায় এই কথা জানিয়ে
আমার সম্প্রদায়ের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছি,
কিন্তু বহু বছর ধরে আমাদের পরিবার
একে অপরের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে আসছে।
পরিবেশ খারাপ হতে শুরু করেছে,
ডাকাতি, খুন ও সহিংসতার পরিকল্পনা করা হচ্ছে;
তুমি অবিলম্বে পরিবার কে এখান থেকে বের করে
পূর্ব পাঁঞ্জাবে পাঠিয়ে দাও,
এখানে আমরা তোমাকে বাঁচাতে পারব না।
সব শুনে দাদুভাইয়ের মুখ কালো হয়ে গেল।
করাচি শহরের এই প্রাসাদ-সদৃশ বাড়িতে তাঁর জন্ম।
তাদের সমস্ত সুখ-দুঃখ এই ঘর গুলোর খুঁটিগুলিতে ঝোলানো রয়েছিল।
এই বাড়িটি তিনি তার পিতার কাছ থেকে পেয়েছিলেন।
ঈশ্বরের কৃপায় পৈতৃক ব্যবসাও ভালোই চলছিল।
নিজের আস্থা ও ভরসার ঝুকি নিয়ে তিনি কম্পিত স্বরে বললেন-
'হাসান, গান্ধী ও জওহর লাল কি এটা হতে দেবেন ?'
হাসান তার থুথু গিলে বলল,
'তাদের আসল চেহারা তোমার ভারতে দেখে নিও।
আগামীকাল দুপুরের পর করাচি রেলওয়ে স্টেশন থেকে
একটি ট্রেন ছাড়বে
ভাভী এবং বিটিয়া কে তাতে অবশ্যই তুলে দিও কিন্তূ ।'
রাতের আঁধারে কালো পাঠানি স্যুট পরা
হাসান চাচা আমাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে
পাশের বাড়িতে ভূতের মতো ঢুকে পড়েন,
তিনি আর ফিরে তাকাতেন না।
কিন্তু বহু বছরের পুরনো পরিচয়
শত্রুতায় পরিণত হওয়ার আগেই
তার ঋণ শোধ করেছিল।
সেই রাতে আমাদের বাড়িতে কেউ ঘুমায়নি।
দিদিমা গহনা, মূল্যবান জিনিসপত্র এবং কিছু কাপড়
লোহার ট্রাঙ্কে রাখলেন, লুচি ভাজা হল এবং
আমের আচার রাখলেন।
আর জলের জন্য একটি পাত্র রাখলেন।
সেই রাতে দাদুভাই
ঘরের বারান্দায় হাত মুঠো করে,
পাইচারি করতে-করতে দেওয়ালে টানানো গান্ধীর
মস্ত বড় ছবিটি নামিয়ে আবর্জনার কাছে রাখলেন।
তিনি আশা করেননি যে গান্ধী এই মূল্যে দিয়ে
ভারতের স্বাধীনতা অর্জন করবেন।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম –
'মা, তোমার সেই পুতুলটির কি হল
যা তুমি করাচি থেকে সংঈে নিয়ে এসেছিলে ?'
'ওটা পুতুল নয়, ছিল ভারত মাতা-
যা তোমার দিদিমা
চরকায় মোটা সুতো আর রঙিন কাপড়
দিয়ে তৈরি করে ছিলেন।
আমি প্রতিদিন তাকে সাথে নিয়ে ঘুমাতাম।
ভাটিন্ডা স্টেশন পর্যন্ত ট্রেনের সেই ভিড় বগিতে
সে আমার কোলেই ছিল।
তারপর বারবার খোঁজা-খুঁজি করেও তাকে পাইনি।
এদেশে আজও তাকে খুঁজছি।
মায়ের চোখ ভিজে গেল।
পরিতাপের বিষয় এটাই ;
আমি এই দেশে স্বাধীনতার বহু বছর পরেও,
আমার মায়ের স্বপ্ন দিয়ে তৈরি
সেই ভারত মাতার সন্ধান করছি।
সেই বিস্বাস কে খুঁজে চলেছি
যা ছয় বছরের একটি কন্যার কোলে
বহু বছর আগে করাচি থেকে ভারতে পাড়ি দিয়েছিল।
কি আপনিও আমার সাথে যোগ দিয়ে তাঁর সন্ধান করবেন?
----------------------
(মায়ের জন্ম ১৫ আগস্ট ১৯৪০ সালে সিংধ প্রাঁতের করাচি শহরে
হয়েছিল। ভারতে তিনি পাঁজ্ঞাব, হরিয়ানার অনেক শহরে বসবাস করে
১৯ মার্চ, ২০১৬ সালে দিল্লীর মাটি তে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।)
- রাজেশ্বর বশিষ্ঠ

Post a Comment