অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
আমার প্রতিরোধের আগুন
অরূপ বন্দ্যোপাধ্যায়
চারদিকে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ চলছে, চলবে। রাস্তায় রাস্তায় মোমবাতির আলো জ্বালাবে তথাকথিত মধ্যবিত্ত শহুরে শিক্ষিত বুদ্ধিজীবীরা, শিল্পীরা দেওয়াল লিখন প্রতিযোগিতায় স্বেচ্ছায় নাম লেখাবে, মিছিল হবে, জনগণের ঢল নামবে শহর ছাড়িয়ে মফস্বলে। সলিল চৌধুরীর গান গাইবে বেসুরো গলা- আমার প্রতিবাদের ভাষা, আমার প্রতিরোধের আগুন…। তবু কি প্রতিরোধের আগুনে দ্বগ্ধ হবে নারী নির্যাতকেরা?
নারী নির্যাতকদের পশুদের সাথে তুলনা করা হয়, যার অর্থ হচ্ছে পশুদের হীন চোখে দেখা। পশুদের দুনিয়ায় পুরুষ দাম্ভিক সমাজ আছে কিনা জানা নেই, খুব সম্ভব নেই। আর থাকলেও, মানুষের কাছে সেই পশুরা শিশু। তারা বধূ হত্যা করে না, নাবালিকা সাবালিকা জ্ঞান রাখে, আরও অনেক মনুষ্যচিত গুণের বড়ই অভাব তাদের। তাই তারা পশু, মানুষ নয়।
নারীকে পণ্য করা হয়েছিল ঠিক কবে জানা নেই, না তা জানা সম্ভব। মানুষ যখন গুহাতে বসবাস করত, তখন যূথবদ্ধ সমাজে নারীদের দাপট ছিল সবচাইতে বেশি। সম্পদ জমা করার অভ্যেস তখনো মানুষ রপ্ত করতে পারেনি, কাজেই ভোগবাদ তাদের সিলেবাসের বাইরে ছিল। পুরুষরা যেত শিকারে। নারীরা সেই শিকার করে আনা কাঁচা মাংস রান্না করা, সন্তানদের প্রতিপালন করা, ইত্যাদি কাজে গুহাতেই ব্যস্ত থাকত। পুরুষদের মধ্যে দুর্বলতম, অলস ব্যক্তিটি হয়ত ধমক খেত যূথের প্রতিপালিকার কাছে। হ্যাঁ, প্রতি যূথে একজন করে রমণী থাকতেন, যিনি ইচ্ছে হলেই যূথ থেকে কোনও দুর্বল বা অলস ব্যক্তিকে বার করে দেবার ক্ষমতা রাখতেন। তাই ধরা যায়, সেই যূথনেত্রীর অনুশাসন না মানার অর্থ হত গুহার বাইরে প্রাকৃতিক ঝঞ্ঝার শিকার হয়ে, বা না খেতে পেয়ে মৃত্যু। তখন দলবদ্ধ ভাবে শিকার করতে হত, হাতিয়ারের অভাবে একা জন্তুদের সাথে লড়াইয়ে কেউ এঁটে উঠতে পারত না। কাজেই যূথ নেত্রীর আদেশ ছিল শেষ কথা।
গুহা থেকে বেরিয়ে যখন নদী উপত্যকায় মানুষ বসবাস করতে লাগল, তখন শিখল চাষআবাদ। আর সেই আবিষ্কারটাও নাকি হয়েছিল নারীদের হাতে। বীজ ফেললে ধরণী ফসল ফলায়, নারীরা পুরুষদের চাইতে অনেক আগেই এই শিক্ষাটা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লাভ করেছিল।
ধরণী তখন সুজলা সুফলা। পশুপালন করত মেয়েরাই। পশুদের চরাতে নিয়ে যেত পুরুষরাই, কারণ বাইরের পরিশ্রমটা তাদের হাতেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। পশু চরানো মানে মাঝেসাঝে আলসেমি করলেও কে বা দেখতে আসছে! তাই পশুপালকরা অলস হল। শস্য কাটা, সেই শস্য মাড়াই করা, সব গচ্ছিত হল নারীদের হাতে। অতিরিক্ত সম্পদ জমা হতে লাগল। কোনও কোনও জায়গায় বৃষ্টির অভাবে ফসলে টান পড়তে লাগল।
ক্রমশ বেড়ে গেল মানুষের সংখ্যা। শস্য আর পশুর উপর ডাকাতি হতে লাগল। কাদের হাতে ডাকাতির ভার পড়ল? পুরুষদের হাতে। কারণ শিকার করা যাদের অভ্যেস, তারাই হয়ে উঠল যোদ্ধা। যুদ্ধ মানেই বল প্রয়োগের, নিজের ক্ষমতার উৎকর্ষ দেখানোর উপযুক্ত জায়গা। যুদ্ধ করতে গেলে লাগে দলপতি। সে-ই হয়ে উঠল রাজা। নারীর হাত থেকে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল পুরুষের হাতে।
ফসল ফলছে না? ডাকো ঈশ্বরকে। তিনি ছাড়া আর কে-ই বা দেবেন গোলা ভরা ধান, আর দুধেল গাই? ঈশ্বরের আরাধনা করতে এগিয়ে এল যারা, তাদের চিহ্নিত করা হল পুরোহিত হিসাবে। রাজার দুঃসময়ের সাথী, আনন্দের দিনের ভাগীদার হল তারা। যার যত পণ্য, সে তত বেশি পরাক্রমই। যুদ্ধ করতে গেলে পুরুষ চাই, নারী নয়। তাই পুরহিতের দায়িত্ব গেল বেড়ে। ঈশ্বরের কাছে সে খাদ্য চাইবে, আর রাজার জন্য পুরুষ সন্তান। নারীরা তবে কী করবে? বাহুবলে নারীদের উপর অধিকারের দাবি জানাতে তাদের পণ্য করে দিল পুরুষতান্ত্রিক সমাজ। রাজার বহু রমণী। তার নিত্যনতুন শয্যাসঙ্গী চাই। একাধিক বিবাহে মন রোচে না। উপপত্নী চাই। পুরুষ সন্তান যুদ্ধে কাজে আসে, নারীদের কী কাজ? সে শুধু পুরুষের মনোরঞ্জন করবে।
সমাজ সৃষ্টি হল বিবর্তনে। বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হলে তবেই নারীকে ভোগ করা আইনত সিদ্ধ বলে মনে করা হবে। পরপুরুষের চোখ থেকে নিজের সম্পদকে আড়াল করতে হবে। নারীদের পাঠিয়ে দেওয়া হল পর্দার আড়ালে। সমাজে সর্বসমক্ষে এলে তার সমূহ বিপদ। যার সে পণ্য, সে হয়ে যাবে বিপন্ন যদি বিবাহিত নারীটি অন্যের ভোগ্য হয়ে যায়।
সভ্যতা যতই এগোতে লাগল, নারী পুরুষের বৈষম্য তীব্র হতে থাকল। বর্বর থেকে মধ্যযুগ পর্যন্ত সমাজের ইতিহাসটা অনেকটা এমনই। বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে আরও বেশি করে যন্ত্র আবিষ্কার হতে লাগল, ভোগ্যপণ্যর চাহিদা বাড়ল। কাজেই নারীদের অবস্থান আরও নিম্নগামী হল। ক্ষমতার লড়াইয়ে বিশ্বযুদ্ধ লাগল। লড়াইতে পুরুষ সেনারা পরিবারের থেকে দূরে থাকবে বলে সেই সময়ে ‘কমফর্ট গার্ল’ পাঠানো হতে লাগল যুদ্ধক্ষেত্রে। সভ্যতার চাকা ঘুরতে লাগল।
শিল্প বিপ্লব এল ইউরোপ জুড়ে। দেশগুলো সমৃদ্ধ হতে লাগল। নারীরা সেখানে অনেকটাই স্বাধীনতা পেয়ে গেল। কিন্তু কাঁচামাল ও শ্রমের স্বার্থে বিশ্ব জুড়ে বসল উপনিবেশের থাবা। উপনিবেশে মানুষ যত গরিব হতে লাগল, যত তার স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হল, তত কমে গেল নারীদের কদর। শিল্পপতিরা কাঁচামালের সাথে আরও একটা পণ্য জুড়ে দিল তাদের খাতায়— নারী মাংস।
পৃথিবীর সব জায়গায় একই রকম ভাবে শিল্প- বাণিজ্যের বিকাশ ঘটল না। নারী পুরুষের ব্যবধান ও বৈষম্য বেড়ে চলল। আধুনিক তথাকথিত সভ্য সমাজে তাই নারীর স্থান হল পুরুষের নিচে। সাম্প্রতিক ঘটে চলা ধর্ষণ কাণ্ড তাই কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। পুরুষের অধিকারের দাবি, তার ভোগলিপ্সার অবশ্যম্ভাবী প্রকাশ হচ্ছে নারী নির্যাতন। বর্তমান ভারতীয় রাজনীতি এখনও আধা সামন্ততান্ত্রিক, দলনেতারা যতই প্রকাশ্যে গলা ফাটিয়ে গণতন্ত্র এবং নারী স্বাধীনতার কথা প্রচার করুক না কেন। ভোটের সময়ে বিপুল সংখ্যক নারীর মতদান তাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই শিক্ষা থেকে তাদের বঞ্চিত করলেই আখেরে লাভ বেশি, যাতে শ্যাম ও কুল দুইই বজায় থাকে। এখনও যদি কোনও নারী সুশিক্ষিত হয়ে প্রতিবাদের আঙুল তোলে, তার একটাই শাস্তি রাজনীতির দালালরা নির্ধারিত করে রেখেছে, তাদের বেআবরু করে দাও, ধর্ষণ করে উচিত শিক্ষা দাও পুরুষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধতা করার।
আজ আর আবেগে ভেসে যাবার দিন নয়। প্রতিবাদ জোরালো করার সময় এসেছে। আর সেই ক্ষমতা আছে বিপুল সংখ্যক মানুষের, নারী পুরুষ নির্বিচারে। ত্রাতা কৃষ্ণের অপেক্ষায় না থেকে সভ্য সমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে সমাজের খোল ও নলচে বদলে দেবার জন্য।

Post a Comment